ভূমিকা : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যের একজন অমর কবি, নাট্যকার, গল্পকার, গায়ক, এবং দার্শনিক। ১৮৬১ সালের ৭ই মে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ঠাকুর পরিবারের মধ্যে জন্মগ্রহণ করায় ছোটবেলা থেকেই শিল্প ও সাহিত্য চর্চার সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। তাঁর কবিতা, গানের কথা, নাটক এবং গদ্যরচনা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে একটি নতুন ধারার সূচনা করে।
রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি ব্যাপক ও বৈচিত্র্যময়। তাঁর রচিত “গীতাঞ্জলি” (১৯১০) বিশ্বজুড়ে সাহিত্যপ্রেমীদের মধ্যে বিশেষভাবে সমাদৃত হয় এবং ১৯১৩ সালে তিনি প্রথম এশিয়ান হিসেবে নোবেল সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন।
তিনি প্রকৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা এবং মানবিক সম্পর্কের জটিলতা বোঝার চেষ্টা করেছেন। তাঁর কবিতাগুলো যেমন প্রেম, সৌন্দর্য ও প্রকৃতির মাঝে, তেমনি রাজনৈতিক ও সামাজিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রেও অগ্রগামী।
রবীন্দ্রনাথের রচনাগুলি প্রভাবিত করেছে সমাজ, সংস্কৃতি এবং রাজনৈতিক আন্দোলনের উপর, এবং তাঁর গান “আমার সোনার বাংলা” স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় একটি উজ্জীবক সঙ্গীত হয়ে উঠেছিল।
সামগ্রিকভাবে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য এবং সঙ্গীত আজও মানুষের হৃদয়ে জীবন্ত এবং প্রাসঙ্গিক। তাঁর চিন্তা ও দর্শন সমৃদ্ধ করে বাংলা সাহিত্যকে, এবং তিনি আজও আমাদের মধ্যে আলো ছড়িয়ে দেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা কবিতা
কবিতার নাম | বিবরণ | মনোভাব |
---|---|---|
গীতাঞ্জলি | কবির প্রার্থনা ও অন্তর্দৃষ্টির সংমিশ্রণ | আধ্যাত্মিকতা ও প্রেম |
বীরপুরুষ | দেশের জন্য সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ | জাতীয়তাবোধ ও গৌরব |
চোখের বালি | প্রেমের জটিলতা ও মানবিক সম্পর্ক | দুঃখ ও বিচ্ছেদ |
আমাদের ছোট নদী | প্রকৃতির সৌন্দর্য ও সরল জীবন | প্রশান্তি ও শৈশবের স্মৃতি |
বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর | বৃষ্টির আবহাওয়া ও রোমাঞ্চ | আনন্দ ও উচ্ছ্বাস |
দুই পাখি | প্রেমের বিচ্ছেদ ও অভাব | দুঃখ ও বৈরাগ্য |
শেষের কবিতা | প্রেমের দুঃখ ও বিদায় | আবেগ ও অন্তর্দৃষ্টি |
পূজা | ঈশ্বরের প্রতি নিবেদন ও কৃতজ্ঞতা | আধ্যাত্মিকতা ও সৃষ্টির প্রতি শ্রদ্ধা |
সোনার তরী | স্বপ্নের অনুসন্ধান | আশাবাদ ও স্বাধীনতা |
বসন্ত | নতুন জীবনের সূচনা ও আনন্দ | উল্লাস ও নবজীবন |
মেঘের খেলা | প্রকৃতির খেলা ও পরিবর্তন | সৌন্দর্য ও মায়া |
দূরত্ব | বিচ্ছেদের অনুভূতি | দুঃখ ও শূন্যতা |
চিরদিনের গান | কালচক্র ও জীবনযাত্রার কথা | দার্শনিকতা ও জীবনবোধ |
কাটাকুটি | সহজ সরলতা ও নিখুঁত সৃষ্টির কথা | কৌতূহল ও মজাদারতা |
জনমত | মানুষের মধ্যে প্রতিক্রিয়া | সমাজ ও পরিবর্তনের চেতনা |
সহজপাঠ | শিক্ষার মৌলিকত্ব | জ্ঞান ও উদ্যম |
পথিক | যাত্রার ও মানসিক পরিবর্তন | অন্বেষণ ও আত্মিক ভ্রমণ |
নিশীথে | রাতের নীরবতা ও স্বপ্নের প্রতিফলন | গূঢ় ভাবনা ও কল্পনা |
নবীন | নতুন প্রজন্মের আবেগ ও উন্মুক্ততা | আশা ও সম্ভাবনা |
প্রকৃতির পুষ্পরেণু | প্রকৃতির সৌন্দর্য ও ফুলের রহস্য | রূপ ও প্রশান্তি |
বিপ্লবী | পরিবর্তনের সংগ্রাম ও মনোবল | সাহস ও সংগ্রামী চেতনা |
আলোকের এই ঝর্ণাধারায় | আলোর প্রতীক ও উদ্দীপনা | উদ্বুদ্ধকরণ ও অনুপ্রেরণা |
ওরে গ্রহবাসী | মানব জীবনের সংকট ও চিন্তা | দার্শনিকতা ও অন্বেষণ |
উদয়ের পথে | নতুন সূর্যের আলো ও পরিবর্তন | আশা ও নতুন সূচনা |
হৃদয়ের শব্দ | হৃদয়ের অনুভূতি ও প্রেমের গতি | আবেগ ও গভীরতা |
দুর্গেশনন্দিনী | মাতৃশক্তির পূজা ও সৃষ্টির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা | ভক্তি ও আধ্যাত্মিকতা |
আলো আমার আলো | আলোর উৎস ও সৃষ্টির কথা | আলোক ও জ্ঞানের সন্ধান |
ওগো মা তোর মুখের বাণী | মাতৃস্নেহ ও তাঁর কাছে প্রার্থনা | স্নেহ ও কৃতজ্ঞতা |
ফুলের বন্ধুরা | প্রকৃতির সৌন্দর্য ও প্রেমের অনুভূতি | আনন্দ ও সৌন্দর্য |
আমার সোনার বাংলা | দেশের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা | জাতীয়তাবোধ ও প্রেম |
বিলম্বিত | সময়ের গতিপথ ও প্রত্যাশার চিত্র | দুঃখ ও অভাব |
মৃত্যুর বার্তা | মৃত্যুর বিষয়বস্তু ও চিন্তা | জীবনের মূল্যবোধ |
নৈবেদ্য | সৃষ্টির প্রতি নিবেদন | আধ্যাত্মিকতা ও আত্মত্যাগ |
কাব্যগ্রন্থের কবিতা | কবিতার বিচিত্রতা ও সাহিত্যের গভীরতা | শিল্প ও ভাবনা |
চরণধূলি | প্রিয়জনের স্মৃতি ও মাটি | প্রেম ও স্মৃতি |
গগনবিহারী | মুক্তি ও আকাশের সৌন্দর্য | স্বাধীনতা ও আনন্দ |
রজনীর কাব্য | রাতের গহনতা ও মায়াবী সৌন্দর্য | রহস্য ও সৌন্দর্য |
অপরাজিতা | মহিলার শক্তি ও প্রতিক্রিয়া | শক্তি ও শক্তিশালী |
কনকচাঁপা | প্রেমের আবেগ ও সৌন্দর্য | রোমান্স ও অনুভূতি |
তরঙ্গিনী | প্রেমের উচ্ছ্বাস ও জীবনের স্রোত | জীবন ও প্রেমের গতিবিধি |
ছুটির দিন | ছুটির আনন্দ ও মুক্তি | আনন্দ ও অবসরের অনুভূতি |
সাঁঝবেলা | সন্ধ্যের রঙ ও শান্তির আবহ | প্রশান্তি ও সৌন্দর্য |
তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা | সন্ধ্যার মায়া ও সৌন্দর্য | মায়া ও রোমাঞ্চ |
মেঘের খেলা | প্রকৃতির খেলা ও আবহাওয়ার পরিবর্তন | আনন্দ ও সৌন্দর্য |
পাখির ডাক | প্রকৃতির সঙ্গী ও স্বাধীনতার প্রতীক | মুক্তি ও স্বাধীনতা |
বাউল | ভ্রমণ ও জীবনদর্শন | বাউল ও সংস্কৃতির চেতনা |
আঁধার রাত | রাতের অন্ধকার ও নিঃসঙ্গতা | নিঃসঙ্গতা ও প্রতিফলন |
জাগরণ | নতুন দিনের সূচনা ও জাগরণের আহ্বান | আশা ও নতুনত্ব |
স্বপ্নের মৃত্যু | স্বপ্নের দুঃখ ও সত্যের অনুসন্ধান | হতাশা ও উপলব্ধি |
আত্মা ও ঈশ্বর | আধ্যাত্মিক প্রশ্ন ও মানব জীবন | আত্মিক উন্মেষ ও অনুসন্ধান |
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা
কবিতা নিয়ে আমাদের এই প্রথম পোস্ট জানিনা কেমন হবে। যদি আপনার ভালো লাগে তাহলে কমেন্ট করে যাবেন। এমন কবিতা যদি আপনারা চান তাহলে আমরা অন্য কবি নিয়ে লিখবো ?
রবীন্দ্রনাথের আসল নাম কি?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আসল নাম ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি ৭ মে, ১৮৬১ সালে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন এবং বাংলা সাহিত্য, গান এবং শিল্পকলায় তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য বিশ্বব্যাপী পরিচিত। তিনি “গীতাঞ্জলি” সহ বহু কবিতা, গল্প, নাটক এবং গান রচনা করেছেন এবং ১৯১৩ সালে প্রথম এশীয় হিসেবে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত কবিতা
- ১. গীতাঞ্জলি – এটি তাঁর সবচেয়ে পরিচিত কাজ এবং বাংলা সাহিত্যের একটি মাস্টারপিস। এই কাব্যগ্রন্থের জন্যই তিনি ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন।
- ২. চোখের বালি – এই কবিতায় প্রেম ও বিচ্ছেদের জটিলতা ফুটে উঠেছে।
- ৩. আমাদের ছোট নদী – এটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও শৈশবের স্মৃতি তুলে ধরে।
- ৪. বৃষ্টির পরে – এই কবিতাটি বৃষ্টির আনন্দ ও আবহাওয়া নিয়ে লেখা।
- ৫. শেষের কবিতা – এটি প্রেমের জটিলতা ও বিদায়ের ভাব প্রকাশ করে।
- ৬. মেঘের খেলা – এই কবিতায় প্রকৃতির খেলা ও মেঘের রূপ দেখানো হয়েছে।
- ৭. সোনার তরী – এখানে স্বপ্নের অনুসন্ধান ও মুক্তির কথা বলা হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ছোট কবিতা
সোনার তরী
গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।
কূলে একা বসে’ আছি, নাহি ভরসা।
রাশি রাশি ভারা ভারা
ধান কাটা হ’ল সারা,
ভরা নদী ক্ষুরধারা
খর-পরশা।
কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা।
একখানি ছোট ক্ষেত আমি একেলা,
চারিদিকে বাঁকা জল করিছে খেলা।
পরপারে দেখি আঁকা
তরুছায়ামসীমাখা
গ্রামখানি মেঘে ঢাকা
প্রভাত বেলা।
এ পারেতে ছোট ক্ষেত আমি একেলা।
গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে!
দেখে’ যেন মনে হয় চিনি উহারে।
ভরা-পালে চলে যায়,
কোন দিকে নাহি চায়,
ঢেউগুলি নিরুপায়
ভাঙ্গে দু’ধারে,
দেখে’ যেন মনে হয় চিনি উহারে!
ওগো তুমি কোথা যাও কোন্ বিদেশে!
বারেক ভিড়াও তরী কূলেতে এসে!
যেয়ো যেথা যেতে চাও,
যারে খুসি তারে দাও
শুধু তুমি নিয়ে যাও
ক্ষণিক হেসে
আমার সোনার ধান কূলেতে এসে!
যত চাও তত লও তরণী পরে।
আর আছে?—আর নাই, দিয়েছি ভরে’।
এতকাল নদীকূলে
যাহা লয়ে ছিনু ভুলে’
সকলি দিলাম তুলে
থরে বিথরে
এখন আমারে লহ করুণা করে’!
ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই! ছােট সে তরী
আমারি সােনার ধানে গিয়েছে ভরি’।
শ্রাবণ গগন ঘিরে
ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,
শূন্য নদীর তীরে
রহিনু পড়ি’,
যাহা ছিল নিয়ে গেল সােনার তরী।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা
হঠাৎ দেখা
রেলগাড়ির কামরায় হঠাৎ দেখা ,
ভাবিনি সম্ভব হবে কোনদিন ।।
আগে ওকে বারবার দেখেছি
লাল রঙের শাড়িতে —
দালিম-ফুলের মত রাঙা;
আজ পরেছে কালো রেশমের কাপড়,
আঁচল তুলেছে মাথায়
দোলন-চাঁপার মত চিকন-গৌর মুখখানি ঘিরে ।
মনে হল, কাল রঙের একটা গভীর দূরত্ব
ঘনিয়ে নিয়েছে নিজের চার দিকে,
যে দূরত্ব সর্ষেক্ষেতের শেষ সীমানায়
শালবনের নীলাঞ্জনে ।
থমকে গেল আমার সমস্ত মনটা :
চেনা লোককে দেখলেম অচেনার গাম্ভীর্যে ।।
হঠাৎ খবরের কাগজ ফেলে দিয়ে
আমাকে করলে নমস্কার ।
সমাজবিধির পথ গেল খুলে :
আলাপ করলেম শুরু —
‘কেমন আছো’, ‘কেমন চলছে সংসার ‘ ইত্যাদি ।
সে রইল জানালার বাইরের দিকে চেয়ে
যেন কাছের-দিনের-ছোঁয়াচ-পার-হওয়া চাহনিতে ।
দিলে অত্যন্ত ছোটো দুটো-একটা জবাব ,
কোনটা বা দিলেই না ।
বুঝিয়ে দিলে হাতের অস্থিরতায় —
কেন এ-সব কথা ,
এর চেয়ে অনেক ভাল চুপ ক’রে থাকা ।।
আমি ছিলেম অন্য বেঞ্চিতে ওর সাথিদের সঙ্গে ।
এক সময়ে আঙুল নেড়ে জানালে কাছে আসতে ।
মনে হল কম সাহস নয় —
বসলুম ওর এক বেঞ্চিতে ।
গাড়ির আওয়াজের আড়ালে
বললে মৃদুস্বরে ,
‘কিছু মনে কোরো না ,
সময় কোথা সময় নষ্ট করবার !
আমাকে নামতে হবে পরের স্টেশনেই ;
দূরে যাবে তুমি ,
তাই, যে প্রশ্নটার জবাব এতকাল থেমে আছে ,
শুনব তোমার মুখে ।
সত্য করে বলবে তো ?’
আমি বললাম ,’বলব’ ।
বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়েই শুধোল,
‘আমাদের গেছে যে দিন
একেবারেই কি গেছে —
কিছুই কি নেই বাকি?’
একটুকু রইলেম চুপ করে ;
তার পর বললেম ,
‘রাতের সব তারাই আছে
দিনের আলোর গভীরে’ ।
খটকা লাগল, কী জানি বানিয়ে বললেম নাকি ।
ও বললে, ‘থাক এখন যাও ও দিকে’
সবাই নেমে গেল পরের স্টেশনে ।
আমি চললেম একা ।।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা
ভাঙা মন্দির
ভীর নাই হল ভিড়
শূন্য তোমার অঙ্গনে,
জীর্ণ হে তুমি দীর্ণ দেবতালয়।
অর্ঘ্যের আলো নাই বা সাজালো
পুষ্পে প্রদীপে চন্দনে
যাত্রীরা তব বিস্মৃতপরিচয়।
সম্মুখপানে দেখো দেখি চেয়ে,
ফাল্গুনে তব প্রাঙ্গণ ছেয়ে
বনফুলদল ওই এল ধেয়ে
উল্লাসে চারি ধারে।
দক্ষিণ বায়ে কোন্ আহ্বান
শূন্যে জাগায় বন্দনাগান,
কী খেয়াতরীর পায় সন্ধান
আসে পৃথ্বী পারে?
গন্ধের থালি বর্ণের ডালি
আনে নির্জন অঙ্গনে,
জীর্ণ হে তুমি দীর্ণ দেবতালয়,
বকুল শিমূল আকন্দ ফুল
কাঞ্চন জবা রঙ্গনে
পূজাতরঙ্গ দুলে অম্বরময়।
প্রতিমা নাহয় হয়েছে চূর্ণ,
বেদীতে নাহয় শূন্যতা,
জীর্ণ হে তুমি দীর্ণ দেবতালয়,
নাহয় ধুলায় হল লুণ্ঠিত
আছিল যে চূড়া উন্নত,
সজ্জা না থাকে কিসের লজ্জা ভয়?
বাহিরে তোমার ওই দেখো ছবি,
ভগ্নভিত্তিলগ্ন মাধবী,
নীলাম্বরের প্রাঙ্গণে রবি
হেরিয়া হাসিছে স্নেহে।
বাতাসে পুলকি আলোকে আকুলি
আন্দোলি উঠে মঞ্জরীগুলি,
নবীন প্রাণের হিল্লোল তুলি
প্রাচীন তোমার গেহে।
সুন্দর এসে ওই হেসে হেসে
ভরি দিল তব শূন্যতা,
জীর্ণ হে তুমি দীর্ণ দেবতালয়।
ভিত্তিরন্ধ্রে বাজে আনন্দে
ঢাকি দিয়া তব ক্ষুণ্নতা
রূপের শঙ্খে অসংখ্য “জয় জয়’।
সেবার প্রহরে নাই আসিল রে
যত সন্ন্যাসী-সজ্জনে,
জীর্ণ হে তুমি দীর্ণ দেবতালয়।
নাই মুখরিল পার্বণ-ক্ষণ
ঘন জনতার গর্জনে,
অতিথি-ভোগের না রহিল সঞ্চয়।
পূজার মঞ্চে বিহঙ্গদল
কুলায় বাঁধিয়া করে কোলাহল,
তাই তো হেথায় জীববৎসল
আসিছেন ফিরে ফিরে।
নিত্য সেবার পেয়ে আয়োজন
তৃপ্ত পরানে করিছে কূজন,
উৎসবরসে সেই তো পূজন
জীবন-উৎসতীরে।
নাইকো দেবতা ভেবে সেই কথা
গেল সন্ন্যাসী-সজ্জনে,
জীর্ণ হে তুমি দীর্ণ দেবতালয়।
সেই অবকাশে দেবতা যে আসে–
প্রসাদ-অমৃত-মজ্জনে
স্খলিত ভিত্তি হল যে পুণ্যময়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা
বিদায়
ক্ষমা করো, ধৈর্য ধরো,
হউক সুন্দরতর
বিদায়ের ক্ষণ।
মৃত্যু নয়, ধ্বংস নয়,
নহে বিচ্ছেদের ভয়–
শুধু সমাপন।
শুধু সুখ হতে স্মৃতি,
শুধু ব্যথা হতে গীতি,
তরী হতে তীর,
খেলা হতে খেলাশ্রান্তি,
বাসনা হইতে শান্তি,
নভ হতে নীড়।
দিনান্তের নম্র কর
পড়ুক মাথার ‘পর
আঁখি-‘পরে ঘুম,
হৃদয়ের পত্রপুটে
গোপনে উঠুক ফুটে
নিশার কুসুম।
আরতির শঙ্খরবে
নামিয়া আসুক তবে
পূর্ণপরিণাম–
হাসি নয়, অশ্রু নয়,
উদার বৈরাগ্যময়
বিশাল বিশ্রাম।
প্রভাতে যে পাখি সবে
গেয়েছিল কলরবে
থামুক এখন।
প্রভাতে যে ফুলগুলি
জেগেছিল মুখ তুলি
মুদুক নয়ন।
প্রভাতে যে বায়ুদল
ফিরেছিল সচঞ্চল
যাক থেমে যাক।
নীরবে উদয় হোক
অসীম নক্ষত্রলোক
পরম নির্বাক্।
হে মহাসুন্দর শেষ
হে বিদায় অনিমেষ,
হে সৌম্য বিষাদ,
ক্ষণেক দাঁড়াও স্থির,
মুছায়ে নয়ননীর
করো আশীর্বাদ।
ক্ষণেক দাঁড়াও স্থির,
পদতলে নমি শির,
তব যাত্রাপথে,
নিষ্কম্প প্রদীপ ধরি
নিঃশব্দে আরতি করি
নিস্তব্ধ জগতে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা
পিঁপড়ে
আহা পিঁপড়ে ছোটো পিঁপড়ে ঘুরুক দেখুক থাকুক
কেমন যেন চেনা লাগে ব্যস্ত মধুর চলা-
স্তব্ধ শুধু চলায় কথা বলা-
আলোয় গন্ধে ছুঁয়ে তার ঐ ভুবন ভ’রে রাখুক,
আহা পিঁপড়ে ছোটো পিঁপড়ে ধুলোর রেণু মাখুক।
ভয় করে তাই আজ সরিয়ে দিতে
কাউকে, ওকে চাইনে দুঃখ দিতে।
কে জানে প্রাণ আনলো কেন ওর পরিচয় কিছু,
গাছের তলায় হাওয়ার ভোরে কোথায় চলে নিচু-
আহা পিঁপড়ে ছোটো পিঁপড়ে সেই অতলে ডাকুক।
মাটির বুকে যারাই আছি এই দুদিনের ঘরে
তার স্মরণে সবাইকে আজ ঘিরেছে আদরে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা
সন্ধ্যায়
ওগো তুমি, অমনি সন্ধ্যার মতো হও।
সুদূর পশ্চিমাচলে কনক-আকাশতলে
অমনি নিস্তব্ধ চেয়ে রও।
অমনি সুন্দর শান্ত অমনি করুণ কান্ত
অমনি নীরব উদাসিনী,
ওইমতো ধীরে ধীরে আমার জীবনতীরে
বারেক দাঁড়াও একাকিনী।
জগতের পরপারে নিয়ে যাও আপনারে
দিবসনিশার প্রান্তদেশে।
থাক্ হাস্য-উৎসব, না আসুক কলরব
সংসারের জনহীন শেষে।
এস তুমি চুপে চুপে শ্রান্তিরূপে নিদ্রারূপে,
এস তুমি নয়ন-আনত।
এস তুমি ম্লান হেসে দিবাদগ্ধ আয়ুষেষে
মরণের আশ্বাসের মতো।
আমি শুধু চেয়ে থাকি অশ্রুহীন শ্রান্ত-আঁখি,
পড়ে থাকি পৃথিবীর ‘পরে–
খুলে দাও কেশভার, ঘনস্নিগ্ধ অন্ধকার
মোরে ঢেকে দিক স্তরে স্তরে।
রাখো এ কপালে মম নিদ্রার আবেশ-সম
হিমস্নিগ্ধ করতলখানি।
বাক্যহীন স্নেহভরে অবশ দেহের ‘পরে
অঞ্চলের প্রান্ত দাও টানি।
তার পরে পলে পলে করুণার অশ্রুজলে
ভরে যাক নয়নপল্লব।
সেই স্তব্ধ আকুলতা গভীর বিদায়ব্যথা
কায়মনে করি অনুভব।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা
দুই বিঘা জমি
শুধু বিঘে দুই ছিল মোর ভুঁই আর সবই গেছে ঋণে।
বাবু বলিলেন, “বুঝেছ উপেন, এ জমি লইব কিনে।’
কহিলাম আমি, “তুমি ভূস্বামী, ভূমির অন্ত নাই।
চেয়ে দেখো মোর আছে বড়ো-জোর মরিবার মতো ঠাঁই।’
শুনি রাজা কহে, “বাপু, জানো তো হে, করেছি বাগানখান
পেলেও দুই বিঘে প্রস্থে ও দিঘে সমান হইবে টানা–
ওটা দিতে হবে।’ কহিলাম তবে বক্ষে জুড়িয়া পাণি
সজল চক্ষে, “করুণ বক্ষে গরিবের ভিটেখানি।
সপ্ত পুরুষ যেথায় মানুষ সে মাটি সোনার বাড়া,
দৈন্যের দায়ে বেচিব সে মায়ে এমনি লক্ষ্মীছাড়া!’
আঁখি করি লাল রাজা ক্ষণকাল রহিল মৌনভাবে,
কহিলেন শেষে ক্রূর হাসি হেসে, “আচ্ছা, সে দেখা যাবে।’
পরে মাস দেড়ে ভিটে মাটি ছেড়ে বাহির হইনু পথে–
করিল ডিক্রি, সকলই বিক্রি মিথ্যা দেনার খতে।
এ জগতে, হায়, সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি–
রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।
মনে ভাবিলাম মোরে ভগবান রাখিবে না মোহগর্তে,
তাই লিখি দিল বিশ্বনিখিল দু বিঘার পরিবর্তে।
সন্ন্যাসীবেশে ফিরি দেশে দেশে হইয়া সাধুর শিষ্য
কত হেরিলাম মনোহর ধাম, কত মনোরম দৃশ্য!
ভূধরে সাগরে বিজনে নগরে যখন যেখানে ভ্রমি
তবু নিশিদিনে ভুলিতে পারি নে সেই দুই বিঘা জমি।
হাটে মাঠে বাটে এই মতো কাটে বছর পনেরো-ষোলো–
একদিন শেষে ফিরিবারে দেশে বড়ই বাসনা হল।
নমোনমো নম সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি!
গঙ্গার তীর স্নিগ্ধ সমীর, জীবন জুড়ালে তুমি।
অবারিত মাঠ, গগনললাট চুমে তব পদধূলি,
ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় ছোটো ছোটো গ্রামগুলি।
পল্লবঘন আম্রকানন রাখালের খেলাগেহ,
স্তব্ধ অতল দিঘি কালোজল– নিশীথশীতল স্নেহ।
বুকভরা মধু বঙ্গের বধূ জল লয়ে যায় ঘরে–
মা বলিতে প্রাণ করে আনচান, চোখে আসে জল ভরে।
দুই দিন পরে দ্বিতীয় প্রহরে প্রবেশিনু নিজগ্রামে–
কুমোরের বাড়ি দক্ষিণে ছাড়ি রথতলা করি বামে,
রাখি হাটখোলা, নন্দীর গোলা, মন্দির করি পাছে
তৃষাতুর শেষে পঁহুছিনু এসে আমার বাড়ির কাছে।
ধিক্ ধিক্ ওরে, শতধিক্ তোরে, নিলাজ কুলটা ভূমি!
যখনি যাহার তখনি তাহার, এই কি জননী তুমি!
সে কি মনে হবে একদিন যবে ছিলে দরিদ্রমাতা
আঁচল ভরিয়া রাখিতে ধরিয়া ফল ফুল শাক পাতা!
আজ কোন্ রীতে কারে ভুলাইতে ধরেছ বিলাসবেশ–
পাঁচরঙা পাতা অঞ্চলে গাঁথা, পুষ্পে খচিত কেশ!
আমি তোর লাগি ফিরেছি বিবাগি গৃহহারা সুখহীন–
তুই হেথা বসি ওরে রাক্ষসী, হাসিয়া কাটাস দিন!
ধনীর আদরে গরব না ধরে ! এতই হয়েছ ভিন্ন
কোনোখানে লেশ নাহি অবশেষ সেদিনের কোনো চিহ্ন!
কল্যাণময়ী ছিলে তুমি অয়ি, ক্ষুধাহরা সুধারাশি!
যত হাসো আজ যত করো সাজ ছিলে দেবী, হলে দাসী।
বিদীর্ণ হিয়া ফিরিয়া ফিরিয়া চারি দিকে চেয়ে দেখি–
প্রাচীরের কাছে এখনো যে আছে, সেই আমগাছ একি!
বসি তার তলে নয়নের জলে শান্ত হইল ব্যথা,
একে একে মনে উদিল স্মরণে বালক-কালের কথা।
সেই মনে পড়ে জ্যৈষ্ঠের ঝড়ে রাত্রে নাহিকো ঘুম,
অতি ভোরে উঠি তাড়াতাড়ি ছুটি আম কুড়াবার ধুম।
সেই সুমধুর স্তব্ধ দুপুর, পাঠশালা-পলায়ন–
ভাবিলাম হায় আর কি কোথায় ফিরে পাব সে জীবন!
সহসা বাতাস ফেলি গেল শ্বাস শাখা দুলাইয়া গাছে,
দুটি পাকা ফল লভিল ভূতল আমার কোলের কাছে।
ভাবিলাম মনে বুঝি এতখনে আমারে চিনিল মাতা,
স্নেহের সে দানে বহু সম্মানে বারেক ঠেকানু মাথা।
হেনকালে হায় যমদূত-প্রায় কোথা হতে এল মালী,
ঝুঁটি-বাঁধা উড়ে সপ্তম সুরে পাড়িতে লাগিল গালি।
কহিলাম তবে, “আমি তো নীরবে দিয়েছি আমার সব–
দুটি ফল তার করি অধিকার, এত তারি কলরব!’
চিনিল না মোরে, নিয়ে গেল ধরে কাঁধে তুলি লাঠিগাছ–
বাবু ছিপ হাতে পারিষদ-সাথে ধরিতেছিলেন মাছ।
শুনি বিবরণ ক্রোধে তিনি কন, “মারিয়া করিব খুন!’
বাবু যত বলে পারিষদ-দলে বলে তার শতগুণ।
আমি কহিলাম, “শুধু দুটি আম ভিখ মাগি মহাশয়!’
বাবু কহে হেসে, “বেটা সাধুবেশে পাকা চোর অতিশয়।’
আমি শুনে হাসি আঁখিজলে ভাসি, এই ছিল মোর ঘটে–
তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে!*
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা শেষ কথা
রবীন্দ্রনাথের কবিতায় প্রেমের চিত্রও অসাধারণ। “আমার সোনার বাংলা” তে তিনি মাতৃভূমির প্রতি গভীর ভালোবাসা এবং কর্তব্যবোধ প্রকাশ করেছেন, যা দেশের প্রতি তার অকৃত্রিম প্রেমকে তুলে ধরেছে। তাঁর কবিতার ভাষা এবং ছন্দ পাঠকের মনে এক ধরনের মাধুর্য সৃষ্টি করে, যা সারা জীবন স্মরণীয় হয়ে থাকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতাগুলো আমাদের মনে অনুপ্রেরণা জোগায় এবং জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের সুযোগ করে দেয়।
তাঁর লেখা কবিতাগুলো আজও আমাদের হৃদয়ে স্থান করে আছে এবং আমাদের চিন্তা-ভাবনাকে সমৃদ্ধ করে চলেছে। রবীন্দ্রনাথের কবিতা যে যুগে লেখা হোক না কেন, সেগুলো আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। এই পোস্টটি কেমন লাগলো নিচের কমেন্ট করে যাবেন।